ইংরেজি : pomegranate। ডালিম উষ্ঞমণ্ডলের একটি অতি প্রিয় ফল৷ বাগান আকারে এর চাষের প্রমাণ না থাকলেও প্রায় বাড়িতেই এর গাছ দেখা যায়৷ শোভাবর্ধনের জন্যও অনেকে ডালিম গাছ লাগিয়ে থাকেন৷ বিশ্বের অনেক দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হলেও বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অনেক বাড়িতে ফল ও শোভাবর্ধনের জন্য এ গাছ লাগানো হয়। ইরানে এর জন্মস্থান হলেও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এর চাষ হয়ে থাকে। পৃথিবীর উন্নত জাতের মধ্যে রুবি, পেপার সেল, ওয়ান্ডারফুল, মাসকেট রেড প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
উদ্ভিদতত্ত্ব
* ডালিম গাছ ছোট লিকলিকে, উচ্চতা ৩-৫ মিটার৷
* পাতা চিকন ও দীর্ঘ৷
* ফুল লাল বর্ণের, কোন কোন গাছে শুধু পুংপুষ্প দেখা যায়৷ আবার কোন কোন গাছে পুং ও স্ত্রী উভয় প্রকার ফুল দেখা যায়৷
* ফল বেরী প্রকৃতির ও প্রায় গোলাকার৷
* ডালিম গাছ পত্রপতনশীল বা চিরহরিত্ হতে দেখা যায়৷
ডালিমের ফলের তুলনায় এর ভক্ষনযোগ্য অংশ খুবই কম৷ ভক্ষণযোগ্য অংশের প্রতি ১০০ গ্রামে ৭৮ ভাগ পানি, ১.৫ ভাগ আমিষ, ০.১ ভাগ স্নেহ, ৫.১ ভাগ আঁশ, ১৪.৫ শ্বেতসার, ০.৭ ভাগ খনিজ পদার্থ, ১০ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম, ১২ মি.গ্রা. ম্যাগনেসিয়াম, ১৪ মি.গ্রা. অক্সালিক এসিড, ৭০ মি.গ্রা ফসফরাস, ০.৩ মি.গ্রা রাইবোফ্লাভিন, ০.৩ মি.গ্রা. নায়াসিন ও ১৪ মি.গ্রা, ভিটামিন সি থাকে৷ ডালিমের রস কুষ্ঠ রোগের উপকারে আসে৷ আযু্বের্দ চিকিত্ সা শাস্ত্রেও এর ব্যবহার সবর্জনস্বীকৃত৷
চাষের মৌসুম: বর্ষাকাল ডালিম চাষের উপযুক্ত মৌসুম৷
উপযুক্ত জলবায়ু: ডালিম চাষের জন্য উষ্ঞ ও শুষ্ক আবহাওয়া খুবই ভাল৷ আদ্র আবহাওয়ার ফলের স্বাদ ভাল হয় না৷
মাটির ধরন: সুনিষ্কাশিত সব ধরনের মাটিতেই ডালিমের চাষ ভাল হলেও সুনিষ্কাশিত গভীর মাটি ডালিম চাষের জন্য উপযোগী৷ বেলে দোঁআশ বা পলিমাটিতে ডালিম গাছ খুব ভাল জন্মে৷ অল্প ক্ষারযুক্ত মাটিতেও এ গাছ জন্মায় ৷ চাষের জন্য উপযুক্ত অঞ্চল : রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও রংপুর এলাকায় ডালিম ভাল জন্মে৷
চারা উৎপাদন : বীজ থেকেই সাধারণত চারা তৈরি করা হয়৷ শাখা বা গুটিকলমের দ্বারা এর অঙ্গজ বংশবিস্তার করা যায়৷
জমি তৈরি ও গর্ত খনন :
* জমি ভালভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করতে হবে৷
* ৪ মিটার দূরে দূরে সারি করে ৪ মিটার দূরে গর্ত করতে হবে৷
* গর্তের আকার হবে ১ মিটার চওড়া ও ১ মিটার গভীর৷
* গর্ত করার ৮-১০ দিন পর গর্তের মাটির সাথে নিম্নলিখিত হারে সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে৷
সারের নাম
পরিমাণ/গর্ত
কমপোস্টের গুঁড়া
৫০০ গ্রাম
ইউরিয়া
১৫০ গ্রাম
টিএসপি
১০০ গ্রাম
এমপি
১০০ গ্রাম
জিপসাম
৭০ গ্রাম
* গর্ত ভরার ২০/২৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে৷
চারা রোপণ
* বর্ষাকাল চারা রোপণের উপযুক্ত সময়৷
* এক বছর বয়সের সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত চারা বা কলম রোপণ করতে হবে৷
* গর্তের মাঝখানে চারা রোপণ করতে হবে৷
* চারা রোপণের পরপরই পানি সেচ দিতে হবে যাতে মাটিতে পযাপ্ত পরিমাণ রস থাকে৷
সার ব্যবস্থাপনা
চারা রোপণের ২ থেকে ৩ মাস পর হতে প্রথম বছর বা ফুল আসার পূর্ব পর্য়ন্ত প্রতি মাসে প্রতি মাসে প্রতি গাছে নিম্নলিখিত হারে সার দিতে হবে৷
সারের নাম
পরিমাণ/গাছ
কমপোস্টের গুঁড়া
৫০ গ্রাম
ইউরিয়া
১৫ গ্রাম
টিএসপি
৫ গ্রাম
এমপি
৫ গ্রাম
অন্তর্বতীকালীন পরিচর্যা
ডাল ছাঁটাই
ডালিমের শাখা-প্রশাখা ছাঁটাই করলে অধিক সংখ্যায় নতুন ডালপালা গজায়, এতে ফলন বৃদ্ধি পায়৷ তাই ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে গাছের মরা ও কীটাক্রান্ত ডাল ইত্যাদি পরিষ্কার করতে হবে৷
শিকড় ছাঁটাই
গাছে সারা বছরই ফুল ও ফল হয়৷ তবে বসন্তে ও বর্ষায় বেশি ফুল আসে৷ বসন্তের ফুল থেকে গ্রীষ্মকালে ফল পাওয়া যায় এবং এর গুণাগুণ খুবই নিম্নমানের হয়ে থাকে৷ কিন্তু বর্ষার ফুল থেকে প্রাপ্ত ফল অক্টোবর-নভেম্বরে সংগ্রহ করা হয় যার গুণগত মান খুবই ভাল হয়৷ তাই গাছকে বর্ষায় ফুল আসতে বাধ্য করার জন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে ১৫সেমি.গভীর করে মাটি খুঁড়ে শিকড়গুলোকে ১৫ দিন উন্মুক্ত করে রাখা হয় এবং পরে জৈব সারসহ মাটি চাপা দিয়ে সেচ দিতে হবে৷
রোগ দমন
এনথ্রাকনোজ
রোগের লক্ষণ: প্রথমে ফলের গায়ে ছোট ছোট বাদামী রঙের দাগ পড়ে৷ পরবর্তীকালে ফল কালো হয়ে ঝরে পড়ে৷
প্রতিকার: আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে৷ ফল ধরার পর ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে বা ১% বর্দোমিশ্রণ ১৫ দিন প পর স্প্রে করতে হবে৷
পোকার বৈশিষ্ট্য
পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতি মধ্যমাকৃতি৷ পুরুষ প্রজাপতি উজ্জ্বল নীলচে বেগুনী এবং স্ত্রী প্রজাপতি বাদামি বেগুনী৷ তবে স্ত্রী প্রজাপতির সামনের পাখায় কমলা রঙের ছাপ বিদ্যমান৷ পূর্ণাঙ্গ শুককীট ১৭-২০ মিলিলিটার লম্বা,গাঢ় বাদামি, গায়ে ছোট ছোট লোম আছে ও সারা শরীরে সাদাটে ছাপ বিদ্যমান৷
ক্ষতির ধরন
শুককীট ডালিমের গায়ে ছিদ্র করে ভিতরে প্রবেশ করে এবং ছিদ্র দিয়ে শুককীটের মল ফলের বাইরে বের হয়ে আসে৷ ফলে ছিদ্রের চারদিকে মল দেখতে পাওয়া যায়৷ আক্রান্ত ফল হতে বিশ্রী গন্ধ বের হয়৷ আক্রান্ত ডালিম মাটিতে ঝরে পড়ে৷ ফল খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে৷
নিয়ন্ত্রণ
আক্রান্ত ফল ও পোকা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে৷ বাড়ন্ত ফলগুলোকে কাপড়ের থলে দিয়ে ডেকে দিতে হবে৷ এত স্ত্রী প্রজাপতি ফলের গায়ে ডিম দিতে পাড়তে পারে না৷ ডালিম গাছে যখন ফল ধরতে শুরু করে তখন ১ মিলিলিটার ফসফামিডন ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতিটি গাছে ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে৷
কাণ্ড ছিদ্রকারী বিটল
পোকার বৈশিষ্ট্য
পূর্ণবয়স্ক বিটলের রঙ হাল্কা হলদে বাদামি৷ সামনের শক্ত ডানা আকারে বড় এবং ধূসর রঙের৷
ক্ষতির ধরন
গ্রাব বা শুককীট গাছের গোড়ায় ছিদ্র করে এবং গাছের রস খায়৷ বিটলগুলো দিনের বেলা সবুজ বিটপ ও বাকল চিবিয়ে খায়৷ গাছের বৃদ্ধি কমে যায়৷
নিয়ন্ত্রণ
১.৫ মিলিরিটার সিসটক্স বা বাইড্রিন ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতিটি গাছে স্প্রে করতে হবে৷
পাতাখেকো বিছাপোকা
পোকার বৈশিষ্ট্য
পূর্ণাঙ্গ পোকা হাল্কা লালচে বাদামি৷ সামনের পাখায় ঢেউ এর মত কয়েকটি লাইন আছে৷ পিছনের পাখা কালো রঙের যার মাঝখানে সাদা ছাপ আছে এবং কিনারায় তিনটিবড় আকারের সাদা দাগ আছে৷
ক্ষতির ধরন
শুককীটগুলো একত্রে দলবদ্ধ ভাবে থাকে এবং সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে৷ অতিরিক্ত আক্রান্ত হলে এরা কচি গাছ একেবারে ছেটে ফেলে৷
নিয়ন্ত্রণ
শুককীট সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে৷ আক্রমণ বেশী হলে ১ মিলিলিটার ডাইক্লরোভস ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতিটি গাছে স্প্রে করতে হবে৷
শুয়ো পোকা
পোকার বৈশিষ্ট্য
পূর্ণবয়স্ক মথ হলদে রঙের৷ পাখায় লালচে দাগ ও কিনারায় কতগুলো ক্ষুদ্র দাগ আছে৷ শুককীট গাঢ় বাদামি রঙের৷
ক্ষতির ধরন
পাতা খেয়ে গাছ একেবারে পাতা শূন্য করে দেয়৷
নিয়ন্ত্রণ
শুককীটগুলো আক্রমণের প্রারম্ভেই শুককীটগুলো সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে৷
ফলের মাছি
পোকার বৈশিষ্ট্য
পূর্ণবয়স্ক মাছি ৭ মিলিমিটার লম্বা, পাখাগুলো রঙহীন৷ বক্ষ মরচে লাল বাদামী রঙের যার মধ্যখানে হলুদ ডোরা দাগ নেই৷ গায়ের রঙ হলুদ, পেট কোনাকার ও গাঢ় বাদামি রঙের৷
ক্ষতির ধরন
শুককীট কাঁচা বা পাকা উভয় রকমের ডালিমের মারাত্মক ক্ষতি করে৷ আক্রান্ত ডালিম বিক্রির অনুপযোগী হয়ে পড়ে৷
নিয়ন্ত্রণ
ফলের মাছি পোকার বংশবৃদ্ধি রোধের জন্য একেবারে সব ফল সংগ্রহ করতে হবে৷ ফল পাকার পূর্বেই ফল সংগ্রহ করতে হবে৷ আক্রান্ত ডালিম ধ্বংস করতে হবে৷ ডালিম সংগ্রহের ২ সপ্তাহ পূর্ব পর্যন্ত কমপক্ষে ৩-৪ বার প্রতিলিটার পানিতে ২ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন বা ডাইমেথোয়েট বা ২.৫ গ্রাম সেভিন মিশিয়ে প্রতিটি গাছে স্প্রে করতে হবে৷ বিষটোপ ব্যবহার করেও এই মাছি পোকা দমন করা যায়৷ বি টোপ তেরির নিয়ম ১২৫ গ্রাম লেড আরসিনেট ২৫০ গ্রাম আখের গুড়ের সাথে মিশাতে হবে৷ তারপর লেড আরসিনেট ও গুড় মিশ্রিত মণ্ডটুকু ৪ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে৷ এই বিষটোপে সিট্রোনেলা তেল যোগ করলে ফল মাছি এতে আরো বেশী আকৃষ্ট হয়৷
তথ্য সূত্র
ফল উত্পাদন ও সংরক্ষণ, প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ ফেরদৌস মন্ডল
বাংলাদেশের কৃষির অনিষ্টকারী পোকামাকড়, তৌহিদ উদ্দিন আহম্মেদ; এ.এফ.এম. আব্দুল জলিল
আমাদের দেশী ফল, কৃষি মন্ত্রণালয়
পরিবেশ বিজ্ঞান: সার ব্যবহার নির্দেশনা (মার্চ ঌ৮), মোঃ সদরুল আমিন
Comments 0